বাংলাদেশের অর্থনীতির রাজনীতি আর জনগণের একতা
বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে কথা বলার এখনই সবচেয়ে ভালো সময়। আমরা প্রায় খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছি। ব্যাংক ব্যবস্থা ভাঙাচোরা, লোনের বিশাল বোঝা দেশের উপরে, কলকারখানায় উৎপাদন ঠিকমতো হচ্ছে না, ১৬ বছরের জমানো চাহিদা একদিনে পূরণ করার জন্য যে যার মতো দাবি নিয়ে রাস্তায় চলে আসছে, আইন-শৃঙ্খলার অবস্থা বেশ বেগতিক, শিল্পাঞ্চলে নিরাপত্তা দিতে পারছি না আমরা, আমাদের গার্মেন্টস খাতে অস্থিরতায় ক্রয়াদেশ ঠিকমতো পালন করতে পারা নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়। এখনই আমাদের অর্থনীতি নিয়ে কথা বলা দরকার। এটাকে ঠিক পথে আনা দরকার। টাকা না থাকলে দেশের কোনো প্রতিষ্ঠানই ঠিকমতো কাজ করবে না, সেটা যেভাবেই সংস্কার করা হোক না কেন।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শক্তি তার মানুষ। অসম্ভব পরিশ্রমী এই মানুষগুলোই সবচেয়ে সস্তায় শ্রম দেয়। তারা এই শ্রম দেশে দেয়, বিদেশে দেয় সস্তায় দেয়। এর উপরে ভর করে আমাদের অর্থনীতি চলে।
কিন্তু আমাদের এই অসম্ভব পরিশ্রমী মানুষরাই আমাদের একটা বড় সমস্যা। কারণ বড়ই আবেগী এই মানুষগুলোকে খুব সহজে বিভ্রান্ত করা যায়। ব্যবসার রাজ্যে কেউ কারও বন্ধু না। সবাই নিজের স্বার্থ দেখে। ব্যবসার দরকার মতো বন্ধুকেও বিভ্রান্ত করে। আর আমাদের সত্যিকারের তেমন কোনো বন্ধু পর্যন্ত নেই।
এখন আমাদের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়িক সম্পর্ক কার সঙ্গে? আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে। আমরা চাইলেই যেমন প্রতিবেশী বদল করতে পারব না। ঠিক একইভাবে চাইলেই বাণিজ্যিক নির্ভরতা কমাতে পারব না। এটা কমানো খুব যে লাভজনক তাও না। ভারত তাদের সুবিধা দেখতে চাইবে সর্বক্ষেত্রে। দীর্ঘ ১৬ বছর নিজের পছন্দমতো প্রায় সব পেয়ে এসেছে তারা। ট্রানজিট থেকে শুরু করে জাতীয় পাঠ্যপুস্তক ছাপানো পর্যন্ত অনেক সুবিধাই তারা পেয়েছে। এখনও তারা পেতে চাইবে। এর সঙ্গে জড়িত অনেক অর্থ। কেউই সুবিধা ছাড়তে চায় না। এটা তো দায় ছাড়া পাওয়া সুবিধা। ছাড়বে কেন?
কিন্তু নতুন বাংলাদেশ তাকে এই সুবিধা দিচ্ছে না বা দিতে চাইবে না। এটা তারা জানে। নতুন বাংলাদেশের এই সরকার পূর্ববর্তী সরকারের মতো তাদের উপর নির্ভরশীল না। তাই স্বাভাবিকভাবেই তারা এই সরকারের সমর্থক হবে না। তারা তাদের বাণিজ্যিক এবং অর্থনৈতিক সুবিধা পুরোটাই ফেরত চাইবে। এটার জন্যই তারা সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে আশ্রয় দিয়েছে এবং আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি সাবেক প্রধানমন্ত্রী তাদের দেশ ছেড়ে কোথাও যেতে চাইলেও তারাই তাকে যেতে দেবে না।
এখন বাংলাদেশের আবেগী মানুষকে সহজে প্রভাবিত করা যায়। তারা বেতন বৃদ্ধির আন্দোলন, পদোন্নতির দাবি, এই দাবি, সেই দাবির চলমান বিভিন্ন আন্দোলনকে প্রভাবিত করতে চাইতেই পারে। বিশেষ দলগুলোকে প্রভাবিত করে আজব অদ্ভুত কথা বলতেই পারে। দরকারে তারা বাঁধের পানি ছেড়ে দেবে, দরকারে পানি আটকিয়ে খরা করবে। প্রয়োজন পড়লে যুদ্ধও করবে না সরাসরি আমাদের সঙ্গে, এটা ভাবার কোনো কারণ নেই।
এই যে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অতিরঞ্জিত গল্প তাদের মিডিয়াতে প্রচার হচ্ছে, সবকিছুকে বিগার পিকচার থেকে দেখতে হবে। ভারতের নিজস্ব অভ্যন্তরীণ সমস্যার অভাব নেই। ভারতের বর্তমান সরকার সমস্যা সমাধানে খুব তৎপর বা সক্ষম এমন অপবাদ মনে হয় না কেউ দিতে পারবে। তবে তাদের বর্তমান সরকারের একটা অসাধারণ গুণ আছে। সেটা হলো সমস্যা থেকে মানুষকে অন্যদিকে চোখ ফেরাতে বাধ্য করা। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ তাদের জন্য খুবই পছন্দের একটা গুটি। কারণ এতে তাদের দুটি লাভ।
প্রথমত, তারা যদি বাংলাদেশের চলমান সমস্যাকে আরও বাড়াতে পারে তাহলে তারা তাদের দেশে বাংলাদেশের সমস্যাকে বড় করে দেখিয়ে তাদের প্রকৃত সমস্যাকে ঢাকতে পারবে। আসামে বাঙালিদের সায়েস্তা করতে সুবিধা হবে। বাংলাদেশকে অনিরাপদ দেখিয়ে তারা তাদের স্বার্থ হাসিল করতে পারবে।
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ আসলেই অস্থিতিশীল হলে তা ভারতের অর্থনীতির জন্য ভালো। কারণ বাংলাদেশের গার্মেন্টস, চামড়ার, আইটি সব ব্যবসা সহজেই ভারত নিতে পারবে, কেননা তাদের সেই অবকাঠামো, এক্সপার্টিজ এবং লোকবল আছে। এতে তাদের রপ্তানি বাড়বে, অর্থনৈতিকভাবে তারা আরও শক্তিশালী হবে।
তাহলে আমরা কী করব?
এটা সত্য আমাদের তাদের সঙ্গে ব্যবসা করতে হবে। না করে উপায় নেই। তাদের সঙ্গে সম্পর্কও পারতপক্ষে স্বাভাবিক রাখতে হবে বাংলাদেশকে। আমরা প্রতিবেশীর সঙ্গে ঝগড়া করে, যুদ্ধ করে ভালো থাকতে পারব না। এখানেই আমাদের সরকারের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ আছেÑ পাওয়ার ব্যালেন্স ম্যানেজ করা। আমরা প্রতিবেশীর হাত থেকে বাঁচতে দূরের অন্য কারও হাতেও পড়তে চাই না। আমাদের প্রতিবেশী থেকে শুরু করে দূর দেশের সঙ্গে সমতা এবং ন্যায্যতার ভিত্তিতে সম্পর্ক তাকি করতে হবে।
এই কারণে মাল্টিলেয়ার ডিপ্লোম্যাসির বিকল্প আমাদের নেই। প্রতিবেশীকে বুঝাতে হবে- আমি ভালো থাকলেই তুমি ভালো থাকবে। প্রতিবেশীকেও বুঝতে হবেÑ আমাকে ঝামেলাতে রেখে সে ভালো থাকবে না।
আমাদের দ্রুত কলকারখানাগুলোকে পুরোদমে চালু করতে হবে। আইন-শৃঙ্খলার পরিস্থিতি ঠিক করতে হবে। ব্যাংক খাতে অস্থিতিশীলতা কমাতে হবে।
আর এসব করতে হলে আমাদের সাধারণ মানুষেরও বেশ বড় একটা ভূমিকা পালন করতে হবে। বিশ্বাস করেন জাতীয় সংগীত বদল হবে কিনা, শহীদের সংখ্যা কত, কে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছে, স্বাধীনতার ইতিহাস কতটা আওয়ামীপন্থি এসব দিয়ে আলাপ আর ঝগড়া করার আমরা অনেক সময় পাব পরে। আবার জিন্নাহ সাহেবের মৃত্যুবার্ষিকী পালন করা দরকার, নাকি কাওয়ালি গানের কনসার্ট করার দরকার সেটা নিয়েও ঝগড়া করার অনেক সময় পাব। কিন্তু সামনের ৯ মাস দেশ যদি ঠিকমতো চলতে না পারে তাহলে, আমাদের দেশটাকেই আমরা ঠিকমতো পাব কিনা সন্দেহ আছে। এই অনিশ্চিত সময়ে, অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু হয়ে গেলে উঠে দাঁড়ানো প্রায় অসম্ভব। তাই সামনের ৯ মাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আমাদের ১৮ কোটি মানুষকে খাওয়াতে হবে। আমাদের ব্যবসা করতে হবে। মানুষের চিকিৎসা করাতে হবে। শিক্ষা দিতে হবে। এসব করতে হবে একেবারে মাথার ওপরে যুদ্ধ আর ষড়যন্ত্রের ছায়া নিয়ে। ১৮ কোটি মানুষ সংখ্যাটাই অনেক। এই সংখ্যার একটা শক্তি আছে। একতাবদ্ধ ১৮ কোটি মানুষ অনেক কিছু পরিবর্তন করে ফেলতে পারে। আমাদের সমস্যা একতাবদ্ধ থাকাতে। একতাবদ্ধ হওয়ার এটাই সময়। সবাইকে নিয়ে এটা সামলাতে হবে। দলমতনির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে।
রুবাইয়াত সাইমুম চৌধুরী : সহযোগী অধ্যাপক, ফিন্যান্স, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি