নতুন কোন বয়ান নয় ; বৃক্ষ তোমার ফলে পরিচয়
নজরুল ইশতিয়াক।
একটি গতিশীল সমাজ অনেকটা নিত্য প্রবাহমান নদীর মত। প্রবাহমান নদীর স্রোতধারায় কত কিছু ভেসে যায়, সমাজ দেহটিও তাই। নদীতে উথাল-পাথাল জোয়ার আসে। আপাত শান্ত সমাজও কখনো কখনো বিক্ষুব্ধ হয়ে ফুলে ফেঁপে ওঠে। তখন সমাজের স্বরূপটি উন্মোচিত হয়ে পড়ে। চেনা সমাজটাকে তখন অচেনা লাগে। কিন্তু একটা বুদ্ধিবৃত্তিক ভুল হলো- আমরা রাজনীতি কিংবা দেশ পরিচালনা নিয়ে যত চিৎকার- চেচামেচি করি আদৌও সমাজটাকে পর্যবেক্ষণ-বিশ্লেষণ করি না। অথচ সমাজেই লুকিয়ে রয়েছে রাষ্ট্র পরিচালনার সত্য-শক্তি, সৌন্দর্য। সমাজটাকে দেখেই রাষ্ট্রকে চেনা এবং করণীয় নির্ধারণ। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের মধ্যে দিয়েও বাংলাদেশের আর্থ- সামাজিক স্বরূপটি বের হয়ে পড়ছে। সমাজের অভ্যন্তরের যে লোকগুলোকে আমরা এক ভাবে চিনতাম- জানতাম, হয়তো তাদের অনেককেই এখন অচেনা মনে হচ্ছে। বিভাজন-বিভেদ, অনৈক্য প্রকাশ পাচ্ছে। যারা ক্ষমতার বলয়ে থাকতে বর্ণচোরা হয়ে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে ছিল এতকাল। তারাই এখন নিজেকে দেখাচ্ছে। সংবাদপত্রে ভেসে আসছে বিগত সরকারের লোকজনের দুর্নীতি, দখলদারিত্ব,লুটপাট, অনিয়মের মহামারীর চিত্র। মব সংস্কৃতির প্রতিফলন এবং ব্যাপক ভাবে বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা ভাংচুরের মত ঘটনাগুলো হয়তো অকল্পনীয় ছিল তরুণ প্রজন্মের কাছে। ৩২ নং সহ বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য সহ ঐতিহ্য বহন করে ভাস্কর্যগুলো এমন হামলার মুখোমুখি হবে তাও হয়তো চিন্তায় ছিল সাধারণ মানুষের। গণ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সাধারণ মানুষ হয়তো কল্পনাও করেনি এমন সহিংসতা, বিভৎসতা। অনেক কিছুই দেখা গেল। জানা গেল বাংলাদেশ নামক দেশটি কোন কালপর্বের যাত্রায় রয়েছে। বস্তুত মানুষ একটি নিরন্তর জীবন সংগ্রামে লিপ্ত রয়েছে। তাকে কোথাও থাকতে হয়, খেতে হয় ঘুমাতে হয়। শত সহস্র বছরের জীবন সংগ্রামের পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। সেই চরম অনিশ্চিত জীবন এখন অনেকটাই নিরাপদ হলেও এই জীবন নতুন নতুন বঞ্চনা, নতুন নতুন বীভৎসতা, বর্বরতা, সংঘাতের জন্ম দিয়ে চলছে। মানুষের ভেতরটা এলোমেলো, অশান্ত-চঞ্চল এবং চরম অনিরাপদ। পুঁজিবাদী তথা শিল্প বিপ্লবোত্তর দুনিয়ায় জীবনটা উপর উপর সুন্দর, মার্জিত মনে হলে ভেতরটা বড্ড এলোমেলো, বেপরোয়া। অনেকটা একটা দামী গাড়ীর মত কিন্তু ব্রেক নেই, নিয়ন্ত্রণহীন। মানুষের সমাজে খুব কম মানুষই দৃষ্টান্ত হয়েছে। ফলে সমাজটা এখনো উন্মাদ, মৃত,বাকোয়াজী, বিভ্রান্ত মানুষে সরগরম। বিচার বুদ্ধিহীন মানুষে ঠাসা। অনেকটা ভাসমান পানা। যেহেতু জীবনের সত্য সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সমাজকে যারা নেতৃত্ব দেয় তারা যেহেতু দৃষ্টান্ত হয়ে উঠতে পারেনি বরং অপরাপর সবাইকে নানাভাবে বঞ্চিত করে নিজেকে একটি সুবিধা জনক নেতৃত্বের জায়গায় রাখার বহুমাত্রিক কুটকৌশলে যুক্ত থাকে। ফলে কখনোই সমাজের বিপুল এবং ব্যাপক সংখ্যক মানুষ সংকটের চোহদ্দি থেকে বের হতে পারে না। এটি পুঁজিবাদী শাসন ব্যবস্থার মৌলিক চরিত্র। এখানে গুটিকয়েক বাজিকর বাকি সবাই সেলসম্যান। ফলশ্রুতিতে সমাজ পরিবর্তনের কাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন কিংবা সম্ভাবনা দেখা দিলেও তা সামাজিক ব্যবস্থাপনা এবং গুটিকয়েক দস্যু তস্করের কারণে সম্ভব হয়ে ওঠে না। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে থেকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে পর্যন্ত গোষ্ঠী স্বার্থ চক্রাকারে জড়িয়ে রয়েছে। সূক্ষ্ম সুতোই বন্দী আমাদের জনজীবন। সেসব চোখে পড়ে না। খোলা চোখে দেখাও যায় না। কেউ কেউ দেখলেও তাকে বাড়তে দেয়া হয় না। কিভাবে তাকে করায়ত্ত করা যাবে কিংবা তার চরিত্র হনন করা, তাকে দালাল হিসেবে তৈরি করা যাবে সেটি পুঁজিবাদী শাসন ব্যবস্থার কৌশল। ফলে আমাদের সামাজিক জীবনে কার্যকর পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে না। ধর্ম, বিভিন্ন তন্ত্র, সংস্কার যাই বলি না কেন সবই পুঁজিবাদী শাসকের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বেহেশতের লোভ দেখিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখার চেষ্টাও থাকে কেননা কেউ সত্য জেনে গেলে পুঁজিবাদী শোষকের কন্ঠ চেপে ধরবে। বাংলাদেশের হাজার বছরের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ অর্জন ১৯৫২ এবং ১৯৭১। এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জনের মধ্য দিয়ে একটি জনগোষ্ঠী জাতি হয়ে ওঠার এবং পরবর্তীতে একটি স্বাধীন দেশ হয়ে আত্মপ্রকাশের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ভৌগলিক একটি স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা হয়। কিন্তু এটি এখনো একটি রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বরং বহুমাত্রিক লুটেরা পুজিবাদী গোষ্ঠীর হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে এবং ব্যবহৃত হচ্ছে। আধিপত্যবাদী গোষ্ঠী সবসময় নিজেদের স্বার্থের জন্য দুর্বল সামাজিক রাজনীতির সুযোগ নিচ্ছে। নতুন নতুন বয়ান তৈরি করে জনমনে নব উন্মাদনা সৃষ্টি করছে। মরীচিকার মত মানুষ না বুঝেই ছুটছে সেদিকে। ইতিহাস বলছে গুজব ও কলহ প্রিয় বাঙালি সহজেই বিভ্রান্ত হয়। বাঙালি স্বভাবে ভেড়ো। বহু বিভাজিত, পশ্চাদপদ সমাজ ব্যবস্থায় অনেক ধরনের অনিশ্চয়তা জারি রাখা হয়। সামাজিক বুননটি থাকে নড়বড়ে। নড়বড়ে সামাজে সহজেই অন্যেরা নাক গলায় এবং তাদের স্বার্থ পূরণে কাজ করে। ফলে এখানে দেশপ্রেম কিংবা ধর্মীয় চিন্তাভাবনা গুলো এত বেশি বিভাজিত ও এত বেশি এলোমেলো থাকে যা একটি জাতিরাষ্ট্রের অগ্রগতির জন্য সহায়ক নয়। রাজনীতিতে কোন দর্শন প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না। আর রাজনীতিতে দর্শন না থাকলে রাজনীতি কিংবা দেশ এগোতে পারে না। আমাদের সংকটটি দার্শনিক- সাংস্কৃতিক,রুচির সংকট। বিচার বিশ্লেষণের ঘাটতি। এখানে একদিকে হাজার বছরের বাঙালির পথ পরিক্রমা ৫২,৬২,৬৪,৬৯,৭১ এর গর্বিত উত্তরাধিকার। বাঙালি জাতীয়তাবোধ, ধর্মনিরপেক্ষতা উদার- অসম্প্রদায়িকতা, আউল- বাউল, বৈঞ্চব,সংস্কৃতি। অন্যদিকে সব মুছে ফেলার প্রবনতা। ধর্মের নামে, অগ্রগতির নামে একটা ধ্বংসের উন্মত্ততা। একটা সীমাহীন বর্বরতা। অথচ যে গাছ উপরে যত বড়, তার শেকড় তত বিস্তৃত ও ব্যাপক। আমরা আমাদের জাতিসত্তাকে অস্বীকার করে কি, কোন কিছু অর্জন করতে পারবো? পৃথিবীর কোন দেশে তো তার জাতিসত্তাকে অস্বীকার করে কিছুই অর্জন করতে পারেনি। বরং সময়োপযোগী পরিবর্তন, রূপান্তর সম্ভব সমস্ত অর্জনকে ভিত্তি ধরে। ভিত্তি ছাড়া তো কিছু দাঁড়ায় না। যে বয়ানই তৈরি করা হোক না কেন সবকিছুর মূলে জনভিত্তি, জনগণের জন্য কিছু করার মহান বাসনা। হোক সেটা ৭১ কিংবা ২৪।
নজরুল ইশতিয়াক
প্রধান সম্পাদক
সাপ্তাহিক কাগজ কলম