আওয়ামীলীগ সরকার পতন পরবর্তী সময় ; কোন পথে
বাংলাদেশ নজরুল ইশতিয়াক
কখনো কখনো ঘটনার আকস্মিকতায়, তাৎক্ষণিকভাবে অনেক কিছু জানা যায় না। জানতেও নেই। কেননা সেই সময়টাতে নানান গালগল্প সাজিয়ে সত্যকে আড়াল করার চেষ্টা থাকে। সত্য জানতে না দেয়াটাও পরিকল্পনার অংশ। সময়ের সাথে সাথে সত্য প্রকাশ পেতে থাকে। সত্য এমনই এক শক্তি যা চাপা দিয়ে রাখা যায় না। বিগত সরকারের পতন যে কেবলমাত্র কোটা সংস্কার আন্দোলনের ফল নয় তা স্পষ্ট হচ্ছে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের সফলতাকে পুঁজি করে সরকার পতনকে ত্বরান্বিত করার কাজটি করা হয়েছে। আর এটি সহজ ছিল না। সেটি সম্ভব হয়েছে জনগণের অংশগ্রহণের ফলে। তাৎক্ষণিক আন্দোলনের চরিত্র ধরতে পারেনি অনেকেই। সুচারু পরিকল্পনা এবং আন্দোলনের কোন একটি পর্বে জীবনবাজী রাখার দৃঢ়তার ফলে ( মাঠে উগ্র ভয়ানক সন্ত্রাসীরা নেমেছিল। এমন ভিডিও ফুটেজ দেখা গেছে) চোখের পলকে এটি হ্যামিলনের বংশীবাদকের মত যাদুকরী ঘটনায় পরিনত হয়েছিল। কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা হয়তো বুঝতেই পারেনি পরবর্তী ধাপে কারা, কারা, কোথায় কিভাবে যুক্ত হবে এবং সরকার পতনের দিকে নিয়ে যাবে গোটা আন্দোলনকে। বিগত সময়ে বহুবার বহুভাবে একটি নির্দলীয় কিংবা তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের চেষ্টা করা হয়েছে। নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের ক্ষেত্র প্রস্তুতিতে আমেরিকা সহ মিত্ররা নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু কোন ভাবেই কোন কাজ না হওয়ায় গণ আন্দোলনে সরকার পতনের বিকল্প ছিল না বিপক্ষ শিবিরের কাছে। সরকার এবং দল হিসাবে আওয়ামী লীগ এবারে আন্দোলনের মোটিভ ধরতে সীমাহীন ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। ছাত্রলীগই যথেষ্ট এবং রাজাকার ট্যাগ দিয়ে আন্দোলনকে থামানোর হাস্যকর চেষ্টা দেখে বুঝা যায় নুন্যতম উপলব্ধি ছিল না। বরং আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছে। সম্প্রতি পরীবাগে সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্রে একটি সেমিনারে -৫ আগস্ট পরবর্তী জাতীয় নিরাপত্তা শীর্ষক পাবলিক লেকচারে সরকার পতন নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানিয়েছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক এসজে কিবরিয়া দীপু। এতে বেশ কিছু পর্যবেক্ষণ ও তথ্য রয়েছে। ডিজিএফআই এবং এনএসআইয়ের পরস্পর বিরোধী তথ্য এবং ভূ-রাজনীতির নানা মেরুকরণ প্রকাশ পেয়েছে। ডিজিএফআইয়ের তথ্য ভুল ছিল বলেও মিঃ কিবরিয়া জানান। তার কথায় আন্দোলনের একটা পরম্পরাও মিলেছে। মিলেছে ভূ- রাজনীতির যোগ। এটা আরো স্পষ্ট হচ্ছে বর্তমানে আমেরিকা সফররত ড. ইউনুসের সাথে জো বাইডেনের অতিরিক্ত মাখামাখি দেখে। ইউনুস সাহেব মহা ফাঁদে পা দিয়েছেন এমনটাই বলাবলি করছে অনেকে। ইউটিউবাররা বলতে শুরু করেছেন ” ড. ইউনুস এখন আমেরিকার কোলে”/ ইউনুস সাহেব বিপজ্জনক খেলায় মেতেছেন ” এসব নানান শিরোনাম। আমেরিকার সাথে অতিরিক্ত সখ্য নানান সংশয় তৈরি করছে। কথায় আছে আমেরিকা যার বন্ধু হয়, তার শত্রু লাগে না। হয়তো ড. ইউনুস নিজেও এখনই অনেক কিছু বুঝতে পারছেন না। চারদিক থেকে তাঁকে বেধে ফেলা হচ্ছে। চাইলেও সহজে বের হতে পারবেন না। ফলে তিনি নির্বাচন প্রশ্নে স্পষ্ট করে কোন রূপরেখা দিতে পারছেন না। আর ১৮ মাস পর নির্বাচন হবে বললেও সেটা নিজের মত করে বলছেন। কোন রাজনৈতিক দলের সাথে নুন্যতম এ নিয়ে আলাপ- আলোচনা করেননি। দেশের ভালো মন্দের কথা তাঁকে সুদূর আমেরিকায় বসে বলতে হচ্ছে। পর্যবেক্ষক মহল বলতে শুরু করেছে -বাংলাদেশ বড় শক্তির খপ্পরে পড়েছে। বাংলাদেশে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব মোকাবিলায় ভারত ও আমেরিকা উদ্বিগ্ন ছিল। চলতি বছরে শেখ হাসিনার চীন সফর কার্যত সফল না হওয়ার বিষয়টিও শেখ হাসিনা সরকারের জন্য দূঃসংবাদ বয়ে এনেছিল । শূন্য হাতে চীন থেকে ফিরেছিলেন শেখ হাসিনা। কোন কিছু কেনাকাটা কিংবা বিশেষ কোন চুক্তিও হয়নি চীনের সাথে সেই সফরে। অথচ তার কিছু দিন সরকার বাজেট পাশ করেছে। অথচ চীন থেকে কোন কিছু ক্রয় করেনি। অথচ পরপর দুই বার ভারতে ছুঁটে গেছেন শেখ হাসিনা । কিছু চুক্তিও করেছে ভারতের সাথে। ভারত ও চীনের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষায় বিগত সরকারের সক্ষমতার অভাব ছিল। স্পষ্টত পররাষ্ট্র দপ্তরের দূরদর্শিতার অভাব ছিল। অনভিজ্ঞ পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাসান মাহমুদ সহ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সীমাহীন ব্যর্থতার কথা উঠে এসেছে এসজে কিবরিয়া দীপুর আলোচনায়। পেশাদার পররাষ্ট্রনীতির অভাবেই বৈশ্বিক রাজনীতি ও কুটনীতিতে মার খেয়েছে বাংলাদেশ। একই সাথে প্রতিবেশী ভারতের সাথে বাংলাদেশের মর্যাদাপূর্ণ সম্পর্ক নিয়ে নানান প্রশ্ন এবং অভিযোগ তো ছিলই জনমনে। সেসবের কোন সুরাহা বিগত সরকার করতে পারেনি। দক্ষিণ এশিয়া নিয়ে আমেরিকার অব্যাহত আগ্রহে শেখ হাসিনা সহায়তা তো করেইনি উল্টো বিভিন্ন সময়ে আমেরিকা বিরোধী মনোভাব দেখিয়েছে। এবং মনে করেছে এতে চীনের আনুকূল্য পাবে এবং ভারত তো পাশে রয়েছেই। ৫ আগস্টের আগে এবং পরে শেখ হাসিনা কোন কোন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলেন সেসব পুরোপুরি উন্মোচন হতে আরো সময় লাগবে। তবে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটেছে এবং বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ হেলিকপ্টারে তাঁকে উড়ে যেতে দেখেছে। পরবর্তীতে গণভবন,জাতীয় সংসদ সহ বিভিন্ন জায়গায় জনতার দখল, লুট। যে যা পেরেছে নিয়ে গেছে। ঐতিহাসিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা সমূহে ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ হয়েছে । মন্ত্রীপাড়ায় লুটপাট,সারাদেশে আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়ীতে হামলা,ভাংচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটেছে। আওয়ামী লীগের লোকজনের ব্যবসা-বাণিজ্যও হাতছাড়া হয়েছে বহু জায়গায় হাট,ঘাট,বাজার,স্কুল, কলেজ সহ বহু কমিটি রাতারাতি অন্যদের দখলে গেছে। আটকে পড়া বহু নেতা-মন্ত্রী দেনদরবার করে পালিয়েছে। বিভিন্ন সংবাদ বিশ্লেষণে জানা গেছে সেনাবাহিনীকে কার্যত শেখ হাসিনাকে আর ক্ষমতায় রাখার ঝুঁকি নেয়নি। শেখ হাসিনা সরকারের পতনকে একটি গণবিপ্লবে রূপ দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। রাজধানী সহ সারাদেশে দেয়ালে দেয়ালে গ্রাফিতিও করা হয়েছে। মব সহিংসতার শিকার হয়েছে অনেকে। দেশে দেশে ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটানোর কাজে আমেরিকার সাফল্য রয়েছে। প্রকাশ্যে আমেরিকাকে নিয়ে যা ইচ্ছে তাই বলার একটা পরিনতি তো হবেই। আমেরিকার পক্ষ থেকে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের চেষ্টা ছিল বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে। কিন্তু সেটা ৫ আগস্টে ঘটবে তা ভাবেনি কেউই। কেননা সবেমাত্র দেশে নির্বাচন হয়েছে এবং এই মুহূর্তে শক্তিশালী কোন আন্দোলনও নেই। আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত কেউই শেখ হাসিনার পতন হবে বলে মনে করতেন না। কারণ মিত্র ভারত পাশে আছে। একেই বলে বিনামেঘে বজ্রপাত। এখন জানা যাচ্ছে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের জন্য দিনের পর দিন কাজ হয়েছে। অনেকগুলো পক্ষ এতে যুক্ত। সরকারের প্রস্তুতি ছিল না। জনগণ সাড়াও দিয়েছে পরিবর্তন আকাঙ্খা থেকেই৷ জনগণের বিপুল অংশগ্রহণ প্রমান করেছে মানুষ নানা কারণে বিগত সরকারের উপর ক্ষুব্ধ ছিল। দেশ পরিচালনায় সীমাহীন ব্যর্থতার জবাব দেয়ার সুযোগ খুঁজছিল জনগণ। কিন্তু কোন পথ খুঁজে পাচ্ছিল না। সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও জনগণের মতামতের প্রতিফলনের কোন সুযোগ সৃষ্টি না হওয়ায় গণ-আন্দোলনে সরকারের পতনের বিকল্পও ছিল না জনগণের হাতে। রাজনীতি নিয়ে গভীরভাবে জানেন এমন একাধিক পক্ষ বলছে- অনেকগুলো রাজনৈতিক দল ২৪ এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ভবিষ্যত কোন একটা আন্দোলনের কথা ভেবেই। পিটার হাস, ডোনাল্ড লু সহ আমেরিকা সরকারের উচ্চপদস্থদের নজীরবিহীন দৌঁড়ঝাঁপের মধ্যে অনেককিছু লুকিয়ে ছিল। যা এখন দৃশ্যমান হচ্ছে। সংস্কার আন্দোলনের ঘাড়ে চেপে সরকার উৎখাতের সে পরিকল্পনা সম্ভব হয়েছে। ভূরাজনীতিতে বাংলাদেশ কিছুটা হলেও গুরুত্ব পাচ্ছে। এই গুরুত্বের অনেকগুলো কারণের মধ্যে একটি হলো চীনা আধিপত্যকে রুখে দেয়া। বঙ্গোপসাগর সহ দক্ষিণ চীন সাগরে মালাক্কা প্রনালীতে নজরদারি রাখা। মায়ানমার সহ বাংলাদেশে রেজিম পরিবর্তন করা। ভারত যেমন নিজ অস্তিত্ব কিংবা নিরাপত্তা প্রশ্নে চীনকে হুমকী মনে করে। আমেরিকাও দক্ষিণ এশিয়ায় নিজেদের আধিপত্য তৈরী করে চীনকে মোকাবিলার কৌশল নিয়েছে। যারপরনাই পেরেশান হয়ে আমেরিকা থেকে ঘন ঘন ডোনাল্ড লু সাহেবদেরকে আসতে হয়েছে বহু পথ পাড়ি দিয়ে। দক্ষিণ এশিয়ায় দুর্বল গণতান্ত্রিক দেশ হিসাবে বাংলাদেশকে বাগে আনতে সাম্ভাব্য সবই করেছে আমেরিকা। টানা ১৫ বছর ক্ষমতা থাকার ফলে অনেকটাই বাস্তবতা বর্জিত রাজনৈতিক দলে পরিনত হয়েছিল আওয়ামী লীগ। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার মত আত্মঘাতি কাজ করলেও নুন্যতম উপলব্ধি ছিল না দলটির। সরকার উৎখাতে ষড়যন্ত্র কিংবা পরিকল্পনা যতই হোক শুরুতেই কোটা সংস্কার আন্দোলনকে মিমাংসা করার সব সুযোগ ছিল আওয়ামী লীগের হাতে। ভূ-রাজনীতির মারপ্যাচে বাংলাদেশ একটা ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনে সার্বভৌমত্বের পতন কি না সেটিও বুঝা যাবে সময়ের সাথে সাথে। কিন্তু এটা অস্বীকারের উপায় নেই যে রাজনৈতিক দল হিসাবে আওয়ামী লীগ জনগণের প্রত্যাশা পূরণে সীমাহীন ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। সরকারের মন্ত্রী ও নেতাদের আচারণে অসন্তুষ্ট ছিল সাধারণ মানুষ সহ দলের ত্যাগী কর্মী সমর্থকেরা। গত ১৫ বছর ছিল খেয়াল খুশির শাসন। সীমাহীন বেকারত্ব, অনিয়ম, হতাশা মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল। কেবলমাত্র অবকাঠামোগত উন্নয়ন আর মুক্তিযুদ্ধের বয়ানে যে কাজ হবে না, সেটা বুঝার সক্ষমতাও ছিল না। প্রতিবাদ করা কিংবা বিরুদ্ধ মতামত প্রকাশেও ভয়,শংকা, উদ্বেগ ছিল। সাধারণ মানুষও মনে করতো আইন আদালত, প্রশাসন চলে নেতাদের কথায়। মামা-খালু কিংবা টাকা না থাকলে নুন্যতম সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যাবে না। এবং এসব অনিয়ম হচ্ছে সরকার এবং সরকারী দলের ইশারায়। কিছু চিহৃিত দুর্নীতিবাজ,লুটেরা সরকারকে ঘিরে ধরেছিল। পরিবারতন্ত্রের মত সেকেলে নোংরামি থেকেও মুক্ত হতে পারেনি শেখ হাসিনা। জনগণ যাদেরকে ঘৃণা করতো তারায় সবচে বেশি গণতন্ত্র ও সুশাসনের কথা শোনাতো। তরুণ প্রজন্ম সরকারের পতনকে নিজেদের জয় হিসাবে নিয়েছিল। একটা পরিবর্তন আকাঙ্খা দানা বেঁধেছিল। পরিবর্তন আকাঙ্খা নিজেই পথ তৈরি করে নেয়।
লেখক: নজরুল ইশতিয়াক প্রধান সম্পাদক সাপ্তাহিক কাগজ কলম